
সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে, দেশে সারের কোনো সংকট নেই। চাহিদার তুলনায় রয়েছে অতিরিক্ত মজুদ। তবে মাঠপর্যায়ের চিত্র ভিন্ন।
সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে, দেশে সারের কোনো সংকট নেই। চাহিদার তুলনায় রয়েছে অতিরিক্ত মজুদ। তবে মাঠপর্যায়ের চিত্র ভিন্ন। দেশের বিভিন্ন জেলার কৃষকের অভিযোগ, চাহিদা অনুযায়ী ইউরিয়া সার পাওয়া যাচ্ছে না। খোলাবাজারে দাম সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। তাই নির্ধারিত মূল্যে সার না পেয়ে অনেক কৃষক বাধ্য হচ্ছেন বেশি দামে কিনতে।
এমন পরিস্থিতিতে ইউরিয়া পাচারের ঘটনা নতুন করে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজার দিয়ে মিয়ানমারে এ সার পাচার হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশটিতে বাংলাদেশের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি দামে ইউরিয়া বিক্রি হওয়ায় একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ও দালাল চক্র এ কাজে জড়িত বলে জানিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একাধিক অভিযানে সম্প্রতি বিপুল পরিমাণ ইউরিয়া জব্দ করা হয়েছে।
প্রশাসনের দাবি তাদের কঠোর নজরদারি ও অভিযানের কারণে পাচারের প্রবণতা কিছুটা কমে এসেছে। তবে কৃষি অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলছেন, ইউরিয়া পাচার পুরোপুরি বন্ধ না হলে দেশের খাদ্য উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে সারের বাজারে তৈরি হবে অস্থিরতা, যা শেষ পর্যন্ত কৃষি খাতকে ফেলবে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে।
নোয়াখালীর সুবর্ণচরে গতকাল একটি ট্রলারসহ ৩৫০ বস্তা ইউরিয়া সার আটক করে স্থানীয়রা। পরে খবর পেয়ে পুলিশ, র্যাব ও কৃষি কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে সারগুলো জব্দ করেন। যদিও এ ঘটনায় কাউকে আটক করা যায়নি। এগুলো মিয়ানমারে পাচারের জন্য নেয়া হচ্ছিল বলে জানিয়েছেন সুবর্ণচর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ।
এর আগে হাতিয়া উপজেলার মাইনুদ্দিন বাজার ও টাঙকি ঘাট এলাকায় স্থানীয়দের সহযোগিতায় ৬৭০ বস্তা ইউরিয়া সারসহ দুটি ট্রাক জব্দ করেছিল প্রশাসন। এ বিষয়ে হাতিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল বাছেদ সবুজ জানান, মূলত নদীপথে সারগুলো পাচারের চেষ্টা করা হয়েছিল। মিয়ানমারে পাঠাতে সারগুলো আনা হয়। একটি চক্র বিভিন্ন উপজেলার ব্যবসায়ীদের নাম ব্যবহার করে ভুয়া কাগজপত্র তৈরির মাধ্যমে এসব সার আনে বলেও জানান তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া সংলগ্ন সমুদ্র এলাকায় গত ২১ সেপ্টেম্বর বিশেষ অভিযান চালায় কোস্টগার্ড। ওই অভিযানে সন্দেহজনক একটি কাঠের বোটে তল্লাশি চালিয়ে ৮৫ বস্তা ইউরিয়া সার, ৮৩ বস্তা সিমেন্ট, ৩৪০ লিটার সয়াবিন তেল জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় তিনজনকে আটকও করা হয়। কোস্টগার্ড সে সময় গণমাধ্যমকে জানায় জব্দ হওয়া মালামাল মিয়ানমারের পাচারের জন্য নেয়া হচ্ছিল।
এর আগে ৮ মে ভোরে সেন্ট মার্টিনের ছেঁড়াদ্বীপের কাছে একটি নৌকায় তল্লাশি চালিয়ে ৭৪২ বস্তা ইউরিয়া সারসহ ১১ জনকে আটক করে কোস্টগার্ড। আটক ব্যক্তিরা উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং চট্টগ্রামের বাসিন্দা বলে কোস্টগার্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল।
জানতে চাইলে কোস্টগার্ডের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারে বিভিন্ন সামুদ্রিক রুট দিয়ে সার পাচারের ঘটনা ঘটছে। তবে কোস্টগার্ডের নিয়মিত টহলের কারণে পাচারকারীরা সুবিধা করতে পারছে না। দেশের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়েই সার পাচারের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। নৌ পুলিশও বিভিন্ন সময়ে তা জব্দ করেছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আমরা নজরদারি বাড়িয়েছি। সমুদ্র উপকূলে কয়েক শিফটে ২৪ ঘণ্টা সার্বক্ষণিক টহল চলছে। সার পাচার রোধে সমুদ্রে চলাচলকারী বোটগুলোতেও তল্লাশি চালাচ্ছি। গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি অভিযানে সার জব্দ ও পাচারকারীদের আটক করতে সমর্থ হয়েছি।’
জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) তথ্যের ভিত্তিতে গত ৯ অক্টোবর কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুল হাসান চৌধুরীর নেতৃত্বে পুলিশ ও কৃষি কর্মকর্তারা সদরের দক্ষিণ স্টেশনের একটি মিলে যৌথ অভিযান চালান। সেখান থেকে ২১৭ বস্তা সার উদ্ধার করা হয়। মিয়ানমারে পাচারের জন্য সারগুলো মজুদ করা হয়েছিল বলে জানান উখিয়ার ইউএনও। তবে অভিযানকালে সারের ডিলার পালিয়ে যান।
জানতে চাইলে উখিয়ার ইউএনও মো. কামরুল হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সম্প্রতি আমরা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে দুটি অভিযান চালিয়ে বেশকিছু সার জব্দ করি। যেসব জায়গায় সার মজুদ করা হয়েছে সেগুলো সীমান্ত এলাকা। আমাদের ধারণা সেগুলো মিয়ানমারে পাচারের জন্যই মজুদ করা হয়। অন্যথায় সীমান্তের কাছে মজুদ করার কথা না। অবৈধ মজুদ করা সেসব সারের মালিকের নামে সরকার বাদী হয়ে মামলা করেছে। সার পাচার রোধে বিজিবি, সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবশ্য কাজ করছে।’
সরকারের নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী দেশে কৃষক পর্যায়ে ইউরিয়া সারের দাম কেজিপ্রতি ২৭ টাকা। সে হিসাবে ৫০ কেজি বস্তার মূল্য পড়ে ১ হাজার ৩৫০ টাকা। অন্যদিকে মিয়ানমারে এ সারের প্রতি বস্তার বর্তমান মূল্য ১ লাখ ১৯ হাজার ৯০০ কিয়াত। বাংলাদেশী মুদ্রায় যা প্রায় ৬ হাজার টাকার কাছাকাছি। মিয়ানমার ফার্টিলাইজার, সিড অ্যান্ড পেস্টিসাইড উদ্যোক্তা সমিতির (এমএফএসপিইএ) বরাত দিয়ে দেশটি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এ তথ্য প্রকাশ করেছে। যদিও এ মূল্য কেবল ইয়াঙ্গুন অঞ্চলের জন্য নির্ধারিত। পরিবহন ব্যয়ের কারণে অঞ্চল ও রাজ্যভেদে এ দাম আরো বেশি পড়ে বলেও জানানো হয় এমএফএসপিইএর পক্ষ থেকে।
বেশি দাম পাওয়ায় সীমান্ত এলাকায় সক্রিয় চোরাকারবারি চক্র দেশের কৃষকদের জন্য বরাদ্দকৃত ইউরিয়া সার পাচার করছে পার্শ্ববর্তী মিয়ানমারে। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্ত হয়ে প্রায় প্রতিদিনই ছোট-বড় চালানে সার পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে জানান স্থানীয়রা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে কিছু চালান ধরাও পড়ছে। তবে অভিযান সত্ত্বেও পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না সার পাচার।
টেকনাফের ইউএনও শেখ এহসান উদ্দীন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সার পাচারের ঘটনা ঘটে এটি সত্য। তবে আমাদের সতর্ক অবস্থানের কারণে তা কমে এসেছে। এখন গভীর সমুদ্র দিয়ে পাচারের চেষ্টা করা হচ্ছে। সম্প্রতি কোস্টগার্ড কয়েকটি অভিযান চালিয়ে সার জব্দ করেছে।’
কক্সবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. বিমল কুমার প্রামাণিক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কিছুদিন আগে অবৈধ মজুদের দায়ে দুই ডিলারের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং সার বরাদ্দ স্থগিত রাখা হয়েছে। তারা অবৈধ মজুদ করেছে এটি সত্যি কিন্তু সেগুলো পাচারের জন্য করেছে, তা এখনো প্রমাণিত নয়। সন্দেহভাজন হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি।’
পাচার ঠেকাতে না পারলে সারের বাজারে কালোবাজারি বেড়ে যাবে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়বে এবং কৃষির উৎপাদন কমে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হবে বলে মনে করেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান মো. রাকিবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সার পাচার হলে দেশে সংকট দেখা দেবে। তখন ব্ল্যাকমার্কেটে বিক্রি বেড়ে যাবে। এতে বেশি দাম দিয়ে কৃষককে সার কিনতে হবে। এর ফলে উৎপাদন খরচ বাড়বে। এমনিতেই দেশের কৃষক ন্যায্য মূল্য পান না। উৎপাদন খরচ বাড়লে কৃষকের ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে। বাজারে পণ্যের দামও বাড়বে। এতে ভোক্তাদের ওপর চাপ তৈরি হবে। মধ্যস্বত্বভোগীরা সেখানে লাভবান হবে। দিনশেষে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের খাদ্য উৎপাদন।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী চলতি মৌসুমে দেশে সারের চাহিদা ৫৮ লাখ টন। দুর্যোগসহ অন্যান্য কারণে যেন সংকট তৈরি না হয়, সেজন্য কৃষি মন্ত্রণালয় অতিরিক্ত আরো ১১ লাখ টন সার মজুদ রাখছে। অন্যদিকে দেশে ইউরিয়ার চাহিদা ২৬ লাখ টন। ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য চার লাখ টন অতিরিক্ত ইউরিয়া সংরক্ষণ করেছে সরকার। চাহিদার আট লাখ টন শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) উৎপাদন করবে বলে আশা কৃষি মন্ত্রণালয়ের। বাকিটা বিদেশ থেকে আমদানি করা হবে।
সার্বিক বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) আহমেদ ফয়সল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ বিষয়টি (পাচার) নিয়ে আরো দুই মাস আগেই আমাদের কাছে অভিযোগ আসে। তখন থেকেই আমরা অ্যালার্ট রয়েছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্থানীয় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, কৃষি অফিসসহ আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত সবগুলো এজেন্সিকে পাচার সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় এজেন্সিগুলো এখানে কাজ করছে। আমরা পাচার রোধে শক্ত অবস্থানে আছি। প্রতিনিয়ত সংস্থাগুলোকে চিঠি দিচ্ছি। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সুত্র, বণিক বার্তা

পাঠকের মতামত